শেখ মাহতাব হোসেন ডুমুরিয়া, খুলনাঃ
খুলনার ডুমুরিয়ায় অভয়াশ্রম স্থাপনের ফলে ডুমুরিয়া উপজেলায় মির্জাপুর মরা নদী, বিল শিংগা ও বানিয়াখালী নদীতে সাত বছরে মাছের উৎপাদন তিন গুণ বেড়ে যাওয়ার খবরটি আশাব্যঞ্জক। এর মানে, মাছের উৎপাদন বাড়ানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে তাদের জন্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা। দেশের একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ডুমুরিয়ায় ২০১২ সালে নদী ও খালে মাছের মোট উৎপাদন ছিল মাত্র ১৬০ মে. টন। এখন ২০২৫ সালে এ উৎপাদনের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ মে. টনে, যা ২০১২ সালের তুলনায় তিন গুণের বেশি। মাছের এই উৎপাদন বাড়ার পেছনে কাজ করেছে উপজেলার মৎস্য বিভাগের এ অভয়াশ্রমসমূহ।
এ বিষয়ে ডুমুরিয়ার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জনাব সোহেল মোঃ জিল্লুর রহমান রিগান বলেন যে, বর্তমানে উপজেলা মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে অভয়াশ্রমসমূহ মেরামত করার ফলে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় প্রজাতির মাছের আধিক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অভয়াশ্রম নির্মান, নেট-পাটা উচ্ছেদ, নিষিদ্ধ জাল অপসারণ ও জনসচেতনতামূলক কাজ বৃদ্ধি করা হয়েছে যে কারণে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান উপজেলা মৎস্য বিভাগ।
সরেজমিনে ডুমুরিয়ার মির্জাপুর এলাকায় গেলে দেখা যায়, মির্জাপুর মরা নদীতে স্থাপিত অভয়াশ্রমটি দৃষ্টিনন্দনভাবে সংস্কার করা হয়েছে। অভয়াশ্রমের ভিতর কচুড়িপানার নিচ থেকে মাছ লাফ দিচ্ছে। জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, ২-৩ মাস আগে অভয়াশ্রমটি সংস্কার করার ফলে এই মরা নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আশেপাশের জেলেরা পূর্বের তুলনায় বেশি মাছ পাচ্ছে। অভয়াশ্রমের পাশে কিছুক্ষণ দাড়ালে মাছের খেলা দেখা যায়।
কিন্তু দেশের সব স্থানের চিত্র এ রকম নয়। দেশি মাছের সার্বিক উৎপাদন আগের তুলনায় কমছে। অনেক মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। গত জুলাই মাসে মাছবিষয়ক তিনটি সংস্থার প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পুঁটি, ট্যাংরাসহ ৯১ প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দূষণ ও দখলের কারণে নদী, খালসহ বিভিন্ন জলাভূমিতে দেশি মাছের উৎপাদন কমছে। দেশে এ পর্যন্ত ৩০টি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে, যা দেশি ছোট মাছ খেয়ে তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া পলি পড়ে নদ-নদী ভরাট হওয়ার কারণেও মাছের বিচরণ কমে আসছে। ফলে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মহলের আশঙ্কা, যে হারে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে, সে ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হাওরাঞ্চলসহ দেশের নদ-নদীতে মাছের অভাব পড়বে। এমন একটি সময় আসবে, যখন দেশি মাছ আর পাওয়াই যাবে না। এটা দেশের জন্য অশুভ লক্ষণ। কারণ, আমাদের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ পূরণ হয় মাছ থেকে। গ্রামীণ মানুষের আয়-রোজগারের একটি বড় উৎস্য হচ্ছে মাছ। মাছ রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। তাই মাছের উৎপাদন যে করেই হোক বাড়াতে হবে। কোনো মাছকেই বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না।
তাই এখনই আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি রক্ষার জন্য ডুমুরিয়া অনুকরণে আমাদের দেশের সব স্থানে বেশি বেশি মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। মৎস্য অভয়াশ্রম হচ্ছে জলাশয়ের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সব ধরনের মাছের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও তাদের প্রজননের ব্যবস্থা করা। যদিও অনেক নদী, খাল ও বিলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে, কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাই এখন দেশের বিভিন্ন নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল, প্লাবনভূমি, উপকূলীয় অঞ্চলের উপযুক্ত স্থানে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বেশি করে অভয়াশ্রম স্থাপন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এ জন্য সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরকে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বেশ করে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পাশাপাশি এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।