মনজু বিজয় চৌধুরী, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি॥মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া বামনবিলটিলায় দুপুরের ‘কুরুখ’ মাতৃভাষায় পড়ালেখা শিখতে নিজ উদ্যোগে বাড়ির উঠানে খোলা আকাশের নিচে কুরুখ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। কলেজ পড়ুয়া তিনজন শিক্ষার্থী একাগ্র চিত্তে এসব শিশুদের ভাষাজ্ঞান ও বর্ণমালা শেখাচ্ছেন। মূলত নিজ উদ্যোগেই চা-বাগান জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র এ নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার শিশুরা ভাষা ও বর্ণমালা শিখছে। আমাদের ভাষার নাম হলো কুরুখ ভাষা। কুরুখ ভাষা উচ্চারণ করতে না পারায় আমারা ভাষা চর্চার কুরুখ ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছি ও নিয়মিত পাঠদান করায় প্রতি শুক্রবারে পাঠদান করায়।
গত ৩ বছরে ধরে কোমলমতি শিশু-কিশোর কুরুখ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করছে। বাংলার পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষায় জ্ঞান দক্ষতা অর্জন করছে। উরাং সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। আর ভাষা চর্চার জন্য একটি স্থান খোঁজা হয়। সরকারের কাছে সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর দাবি করছে উরাং সম্প্রদায়।
জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলাই কমলগঞ্জ উপজেলার উরাং জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবরের দিকে দেওড়াছড়া বামনবিল টিলার চা শ্রমিক লালশাই উরাংয়ের বাড়ির উঠানে পাঠদানের জন্য ক্লাস ঠিক করা হয়। ২০১৪ সালের দিকে একটি পত্রিকার মাধ্যমে তাদের জানা যায় দেশে ১৪টি ভাষা বিপন্নের তালিকায় রয়েছে। এরমধ্যে উরাং সম্প্রদায়ের কুরুখ ভাষাও বিপন্নের তালিকায় আছে। মৌলভীবাজারে ৩ হাজার ১৩৮ জন উরাং রয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হলো আমাদের ভাষাটাকে টিকয়ে রাখা। এই ভাষায় কথা বলতে উচ্চারণ করতে পারি কিন্তু উরাং জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ কথা বলতে পারে বাকি ৮০ ভাগ কথা বললে উচ্চারণ করতে পারে না।
কুরুখ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র এর ছাত্রী সিমা উরাং জানান বই নিয়ে আমরা শিখি আমাদের শিক্ষকরা যখন লেখা দেও তখন কুরুখ ভাষাটা খাতায় লিখতে হয়। আমাদের বাবা মা যখন কুরুখ ভাষা কথা বলে আমি বুঝতে পারিনা এটা। আমি এখানে এসে আমাদের স্কুলটি আমি অনেক কিছুই শিখেছি।
কুরুখ ভাষা শিক্ষা কেন্দ এর ছাত্ররা জানান আমাদের স্যাররা এখানে কুরুখ ভাষা শেখান স্কুলের মাধ্যমে। এই পাঠকেন্দ্র হওয়ায় আমার বাড়িতে এখন বাবা মা র সাথে কুরুখ ভাষায় কথা বলতে পারি।
সুর্বণা উরাং বলেন, আমাদের এখানে তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। তারা অনেক দূর থেকেই আসেন পরিশ্রম করে।
বামনবিলটিলায় এলাকার নিম সাই জানান, আমাদের পরিবারের মধ্যে কুরুখ ভাষা বলা হয় আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর এই কুরুখ ভাষা কথা বলতে পারে না। তিন জন শিক্ষক রয়েছে তারা বিনা পয়সায় আমাদের বাচ্চাদেরকে ভাষা শিখছে।
শিক্ষক পুরন উরাং জানান স্কুলের এখানেই ছাত্ররা রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ জন। বর্তমান আমরা নিজ ইচ্ছায় আমরা সেখানে এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কে শিক্ষা দিচ্ছে। নিজেদের মাতৃভাষা দুটি বই কুরুখ ভাষায় প্রথম পাঠ ও অভিধান আমরা ক্লাস চালাচ্ছি। দীর্ঘ তিন বছর ধরে একটা বই দিয়ে আমরা ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছি। তিন বছর থাকলে এই বইটি আর থাকে না, বর্তমানে আমরা খাতায় লেখাপড়া করার।
কুরুখ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র এর শিক্ষক অরুণ উরাং বলেন তিন বছর ধরে কুরুখ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চলমান রয়েছে। আমরা কোন পারিশ্রমিক নেই না আমরা নিজ ইচ্ছায় এখানে ছাত্রদেরকে কুরুখ ভাষায় শিক্ষা দিয়ে থাকি। আমাদের এই ভাষাটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্ত অন্তর্ভুক্ত নেই। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল আমাদের মাতৃভাষাটা আগামী প্রজন্মরা যাতে এই ভাষাটি ভুলে না যায়।
কমলগঞ্জ ১নং রহিমপুর ইউনিয়ন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিতাংশু কর্মকার বলেন কুরুখ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে যাতে হারিয়ে না যায় সেই কারণে এই কুরুখ ভাষাটি আবারো প্রচলিত হয়। এই ভাষাটি আমাদের মধ্যে থাকে আমাদের মধ্যে ব্যবহার করা হয় এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মৌলভীবাজার মোসাঃ শাহীনা আক্তার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন একটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ মাতৃভাষা। সকলের জন্য প্রথম মাতৃভাষা,সবাই যেন বিকশিত হতে পারে সেজন্য সকলকে এগিয়ে আসা উচিত। আমি তথ্যটি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতায় এই কিভাবে রক্ষা করা যায় সেটা আমরা কাজ করবো।