লেখক: এম এইচ মুন্না, প্রধান সম্পাদক, দৈনিক গণতদন্ত
অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন প্রতিদিনই রক্তাক্ত হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের পানিতে। এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনার শিকার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার দুই তরুণ কুদ্দুস ব্যাপারী এবং তাঁর ভগ্নিপতি সুজন হাওলাদার। লিবিয়ার উপকূলে তাদের নৌকাডুবির ঘটনায় একদিকে যেমন দুই পরিবার শোকে ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে ফাঁস হচ্ছে দালাল চক্রের নির্মম প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র।
অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন: ‘বডি কন্ট্রাক্ট’-এর ভয়ঙ্কর ফাঁদ
‘বডি কন্ট্রাক্ট’ নামের একটি প্রলোভনমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে দালাল চক্র অভিবাসন প্রত্যাশীদের ইউরোপে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এই চুক্তির আওতায় থাকা-খাওয়াসহ যাত্রার পুরো খরচ বহনের কথা বলা হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব দালাল চক্র অভিবাসন প্রত্যাশীদের অমানবিক পরিস্থিতিতে ছোট নৌকায় গাদাগাদি করে তুলতে বাধ্য করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ নৌকাগুলো ভূমধ্যসাগরের পানিতে ডুবে যায়, এবং যাত্রীরা সলিল সমাধি হয়।
২৪ জানুয়ারি লিবিয়ার বেনগাজি থেকে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করা একটি নৌকাডুবির ঘটনায় ২৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনায় সুজন হাওলাদারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেলেও কুদ্দুস ব্যাপারীর ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত।
স্বপ্ন, ত্যাগ, আর পরিণতির গল্প
মালয়েশিয়ায় ৭ বছর পরিশ্রম করে দেশে ফিরে আসা কুদ্দুস এবার ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় দালাল মনিরের প্রলোভনে পড়ে তিনি তার দুই বিঘা জমি ৪০ লাখ টাকায় মনিরের স্ত্রী হামিদার নামে লিখে দেন। সুজনও মনিরকে ১৬ লাখ টাকা দেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের এই ত্যাগের বিনিময়ে তারা পেয়েছেন করুণ মৃত্যু।
‘মাফিয়া মনির’: দরজি থেকে মানব পাচার চক্রের নিয়ন্ত্রক
রাজৈরের দরজি মনির শেখ আজ ‘মাফিয়া মনির’ নামে পরিচিত। লিবিয়ায় তার তিন জামাতা মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর থেকেই তিনি মানব পাচারের ভয়ঙ্কর জালে জড়িয়ে পড়েন। কুদ্দুস ও সুজনের মতো অনেক নিরীহ মানুষ তার প্রতারণার শিকার। জানা গেছে, রাজৈর ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে মনিরের। অথচ বিপদে পড়া পরিবারগুলো মামলার কথা চিন্তা করলেও প্রভাবশালী চক্রের ভয় তাদের মুখ বন্ধ রাখে।
মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা জানান, মানব পাচার রোধে পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন দালালের নাম পুলিশের হাতে এসেছে, এবং তাদের ধরতে অভিযান চলছে। তবে তিনি বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আইনি পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছে। প্রশাসনের চেষ্টার পাশাপাশি জনসচেতনতার অভাবও মানব পাচারের এই ভয়ঙ্কর চক্রের বিস্তারে সহায়তা করছে।
পরিবারগুলোর আর্তনাদ
সুজনের স্ত্রী মুন্নী বেগমের আর্তনাদ হৃদয়বিদারক। তিনি বলেন, “১৬ লাখ টাকা ধারদেনা করে দিয়েছি। এখন যমজ দুই সন্তানকে নিয়ে আমি কী করব? বিচার চাই, দালালের কঠোর শাস্তি চাই।” কুদ্দুসের পরিবারও এখনও তাঁর জীবিত বা মৃত অবস্থার কোনো তথ্য জানতে পারছে না। এই কান্না শুধু মুন্নী বা কুদ্দুসের পরিবারের নয়—বাংলাদেশের অসংখ্য অভিবাসন প্রত্যাশীর পরিবারের বাস্তবতা এটি।
সমাধান কোথায়?
অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন যেন আর কোনো পরিবারকে সর্বস্বান্ত না করে, তা নিশ্চিত করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন জরুরি।
শেষ কথা
কুদ্দুস ও সুজনের করুণ মৃত্যুর ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। ইউরোপের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে যেন আর কোনো জীবন এভাবে হারিয়ে না যায়।
> আমাদের প্রজন্মের জন্য এটাই হোক অঙ্গীকার—অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং প্রশাসনিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।