হয়রানি, মিথ্যা মামলা ও হুমকির বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের রক্ষায় নতুন অধ্যাদেশ। বাস্তবায়নে সরকার কতটা আন্তরিক হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশাটি একদিকে যেমন সাহস, ত্যাগ ও জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত, অন্যদিকে বাস্তবে এটি হয়ে উঠেছে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ পেশা। সত্য বলার দায়িত্ব নিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয় হুমকি-ধামকি, মামলা, হয়রানি ও সামাজিক-প্রশাসনিক চাপে। এসব বাস্তবতার মধ্যেই সরকার সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করেছে—‘সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’।
অধ্যাদেশটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, হয়রানি থেকে সুরক্ষা প্রদান এবং তথ্যসূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা। এতে মিথ্যা মামলা দায়েরের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের খসড়া প্রকাশের পর সাংবাদিক সমাজে স্বস্তি ও আশাবাদের একটি ধারা তৈরি হলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এটি কি বাস্তবায়নযোগ্য? নাকি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মোড়কে বন্দি থাকবে?
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখন মূলত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত—প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন। এই তিন পর্যায়েই সাংবাদিকদের পেশাগত জীবনে রয়েছে অগণিত চ্যালেঞ্জ।
প্রিন্ট মিডিয়া: সরকারি সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিজ্ঞাপন বন্ধ, হুমকি কিংবা চাকরিচ্যুতি নতুন কিছু নয়।
ইলেকট্রনিক মিডিয়া: মাঠে রিপোর্ট করতে গিয়ে ক্যামেরা ভাঙচুর, মারধর বা স্থানীয় চক্রের দ্বারা হামলার শিকার হওয়া প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
অনলাইন পোর্টাল: সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন ফ্রিল্যান্স বা অনলাইন ভিত্তিক সাংবাদিকরা। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার এমনকি চরিত্রহননের অপচেষ্টা অত্যন্ত সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের হয় তার একটি বড় অংশই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দুর্নীতির খবর প্রকাশ, প্রভাবশালী ব্যক্তির অপকর্ম উন্মোচন কিংবা রাজনৈতিক নেতার সমালোচনা করলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানি, নারী নির্যাতন, বা রাষ্ট্রবিরোধিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১-২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ২০০ জন সাংবাদিক হয়রানি, মামলা কিংবা হামলার শিকার হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে নতুন অধ্যাদেশটি সাংবাদিকদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠতে পারে, যদি সরকার আন্তরিকভাবে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করে।
অধ্যাদেশের সম্ভাব্য সুফল: নতুন অধ্যাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান রয়েছে, যা কার্যকর হলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে:
1. হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনে শাস্তির বিধান: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, হুমকি বা হামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে।
2. মিথ্যা মামলা দমন: উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
3. তথ্যসূত্র রক্ষার অধিকার: সাংবাদিক চাইলে তথ্যসূত্র গোপন রাখতে পারবেন এবং আইন তাকে সেই সুরক্ষা দেবে।
4. প্রশাসনিক বাধা রোধ: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ সাংবাদিককে জোর করে তথ্য প্রকাশে বাধ্য করতে পারবে না।
সরকারের করণীয় ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ:
আইন প্রণয়নের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার সঠিক বাস্তবায়ন। ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশে অনেক আইনই আছে যা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না বা হয় পক্ষপাতদুষ্টভাবে। এই অধ্যাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের শঙ্কা বিদ্যমান।
সরকারের জন্য প্রস্তাবিত করণীয়:
স্বতন্ত্র ‘সাংবাদিক সুরক্ষা কমিশন’ গঠন করা, যাতে সাংবাদিকরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন।
জেলা ও থানা পর্যায়ে ‘সাংবাদিক সুরক্ষা সেল’ গঠন করা, যারা তাৎক্ষণিক সহায়তা দিতে পারবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা, যাতে তারা বুঝতে পারে সাংবাদিকতার সীমা ও অধিকার।
ফ্রিল্যান্স ও অনলাইন সাংবাদিকদের জন্য একটি স্বীকৃতি ও তালিকাভুক্তি ব্যবস্থা চালু করা, যাতে তাঁরা আইনের আওতায় উপযুক্ত সুরক্ষা পান।
সমালোচনা ও সংশোধনের জায়গা:
যদিও এই অধ্যাদেশ একটি সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ, তবুও কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে:
সাংবাদিকের সংজ্ঞা অস্পষ্ট: কারা এই আইনের আওতায় পড়বেন, তা সুস্পষ্ট না থাকলে আইন অপব্যবহার বা অবহেলার আশঙ্কা থেকে যায়।
জাতীয় নিরাপত্তা বনাম তথ্যসূত্রের গোপনীয়তা: সাংবাদিক যদি কোনো সংবেদনশীল বিষয় কাভার করেন, তখন তার তথ্যসূত্র রক্ষায় কী পরিমাণ স্বাধীনতা থাকবে তা স্পষ্ট নয়।
অধিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা: আইনটির ভুল প্রয়োগ হলে এটি উল্টো সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হতে পারে।
এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের মতামত নিয়ে অধ্যাদেশটিকে আরো পরিপূর্ণ ও ব্যালান্সড করা প্রয়োজন।
আইনের চেয়েও বড় হচ্ছে ‘আন্তরিকতা’
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি একটি মূল্যবোধের চর্চা। এই মূল্যবোধ রক্ষায় আইনি সুরক্ষা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজের আন্তরিকতা। প্রস্তাবিত সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ সত্যিই যদি কার্যকর হয়, তবে এটি শুধু একটি আইনই নয়—একটি নৈতিক প্রতিজ্ঞা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এটি হতে পারে এক নতুন সূচনা—যেখানে সাংবাদিকরা নির্ভয়ে সত্য বলবেন, আর সমাজ-রাষ্ট্র তাঁদের পাশে থাকবে। তবে কেবল আইন থাকলেই হবে না, সেটিকে যথাযথভাবে প্রয়োগের সদিচ্ছা থাকতে হবে। তবেই এই অধ্যাদেশ একদিন দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে গর্বের ফলক হয়ে উঠবে।
আলমগীর ইসলাম
জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক